আমরা সবাই একবিংশ শতাব্দীতে বাস করছি- এই সত্যটিকে বিবেচনায় রাখলে, একজন যুবক বা যুবতী ইন্টারনেট ব্যবহার করে না- তা কারও পক্ষে বিশ্বাস করা অসম্ভব। আমাদের প্রত্যেকের অন্তত একটি সামান্য সামাজিক মিডিয়া, হোক সেটা ফেসবুক, বা টুইটার বা ইমো- এর উপস্থিতি আছে! যাইহোক, একটি জিনিস যা আমাদের তাড়িত করে তা হচ্ছে- সাইবার জগতে কীভাবে নিরাপদ থাকা যায়- তা এখানে আলোচিত হচ্ছে।
পাসওয়ার্ড
আপনার নামের মতো সহজ, স্পষ্ট এবং অলসভাবে তৈরি করা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করবেন না। চ্যালেঞ্জিং পাসওয়ার্ডগুলি ব্যবহার করুন যা শুধুমাত্র আপনি জেনে থাকতে পারেন। অনুমান করা আরও কঠিন করার লক্ষ্যে আপনার পাসওয়ার্ডে সংখ্যা, স্পেস এবং চিহ্ন যোগ করুন। আপনার পাসওয়ার্ডগুলি কখনই কাগজে লিখবেন না কারণ কেউ সেগুলি জেনে ফেলতে পারে। এখন বেশ কিছু পাসওয়ার্ড ম্যানেজার, পাসওয়ার্ড জেনারেটার আর পাসওয়ার্ড পরামর্শদাতা সফটওয়্যার পাওয়া যায়। পাসওয়ার্ড একটি উপযুক্ত দৈর্ঘ্যের হওয়া উচিত, খুব ছোট বা খুব দীর্ঘ নয়; বেশিরভাগ ওয়েবসাইট আপনাকে উপযুক্ত পরিসর বলে। আপনার পাসওয়ার্ড নিয়মিত পরিবর্তন করুন এবং সেগুলোকে আপডেটেড রাখুন। এবং দয়া করে, মনে রাখবেন যে পাসওয়ার্ডগুলি অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং সংবেদনশীল বিষয় এবং তাই অত্যন্ত গোপনীয় হওয়া উচিত৷ আপনার পাসওয়ার্ড কখনই কারো সাথে শেয়ার করবেন না, যাই হোক না কেন। একবার এমন একটি প্রতিবেদন বের হয়েছিল যেখানে উল্লেখিত ছিল যে একজন তার ইউটিউবে চ্যানেলটি সাজাতে দেওয়ার জন্য একজন ছদ্দবেশি শুভাকাঙ্ক্ষীকে তাদের পাসওয়ার্ড প্রদান করার কারণে তার প্রথম দুটি বহুল পরিচিত ইউটিউব অ্যাকাউন্ট হারিয়েছে। শুধু চ্যানেল নয় বরং ভিডিও, গ্রাহক, স্মৃতি, এবং ইউটিউব ভিডিও তৈরিকারী বন্ধু।
শর্তাবলী এবং পরিষেবা
সাইন আপ করার আগে যেকোন অজানা বা অপরিচিত ওয়েবসাইটের এই বিভাগটি মনোযোগ সহকারে পড়তে খেয়াল রাখবেন। একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করা বা তথ্য দেওয়া বাস্তব জীবনে একটি “চুক্তি”র মতো, এবং আপনি যদি না দেখেই তা করতে সম্মত হন, তাহলে সম্ভাবনা বেশি যে আপনি সম্ভবত সাইটটিতে আপনার ইচ্ছের চেয়ে বেশি অধিকার এবং তথ্য প্রদান করেছেন বা করতে যাচ্ছেন। আপনার ল্যাপটপ বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসে কোনো সফ্টওয়্যার ইনস্টল করার আগে, শর্তাবলী পরীক্ষা করুন এবং দু’বার চেক করুন, যেগুলি সাধারণত সংক্ষিপ্ত হয় (অন্তত অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ্লিকেশনের জন্য), কারণ এগুলো কখনও কখনও অনেক বেশি অনুমতি চায় এবং আমাদের অধিকাংশ মানুষই সেগুলির অনুমতি প্রদান করে; পরবর্তীতে আমাদের মাঝে কেউ কেউ অনুশোচনা করে ভুল বুঝতে পেরে! সুতরাং, শর্টকাট নেওয়ার চেষ্টা করবেন না; মনে রাখবেন যে ইন্টারনেট শিশুদের খেলা নয়। এটা বাস্তব জীবন; এখানে একটি ছোট ভুল আপনাকে পরে হতাশ করতে পারে। ইন্টারনেটে যেটা একবার যায়, সেটা শত মুছলেও কোথাও না কোথাও থাকবেই।
ভাইরাস সনাক্তকরণ এবং অপসারণ প্রোগ্রাম
অ্যান্টিভাইরাস প্রোগ্রামগুলি ভাইরাসগুলির জন্য আপনার কম্পিউটার স্ক্যান করে এবং সেগুলি সরিয়ে দেয়। আপনার একটি ভালো অ্যান্টি-ভাইরাস প্রোগ্রাম ব্যবহার নিশ্চিত করুন- ফোন এবং কম্পিউটার সব ধরণের ডিভাইসএ। ভাইরাস হল দুষ্টু প্রোগ্রাম যা আপনার সিস্টেমে প্রবেশ করার পরে ক্ষতি করতে পারে এবং এমনকি আপনার হার্ড ডিস্কের সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু মুছে ফেলতে পারে। যদিও এটা করা বেআইনি, অনেক মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে কারো সিস্টেমে ভাইরাস সংযুক্ত করতে পারে। ভাইরাসগুলি সেকেন্ডের মধ্যে আপনার সিস্টেমকে ক্র্যাক ডাউন করতে পারে এবং উল্লেখযোগ্য ডেটা সংগ্রহ করতে পারে। এমনকি এটি একটি স্থানীয় ডিস্কে সংরক্ষিত আপনার প্রথম প্রেমের চিঠিও সংগ্রহ করতে পারে, আর একবার যদি না খারাপ উদ্দেশ্যের মানুষের হাতে পরে- তাহলে কি হতে পারে বুঝতেই তো পারছেন!
অচেনা মানুষ ও অচেনা লিংক থেকে সাবধান
বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী এতটাই বোকা যে তারা বোঝেনা- অনলাইনে সবাইকে বিশ্বাস করা যায় না; এটি ইন্টারনেটের একটি প্রধান অপূর্ণতা। অনলাইনে কোনো অজানা ব্যক্তিকে কখনই পুরোপুরি বিশ্বাস করবেন না বা তাদের কাছে ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করবেন না, কারণ এটা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক হতে পারে । এই ধরনের অনেক লোক প্রতারক, সাইবারবুলি এবং ইন্টারনেট অপরাধী হিসেবে বারবার প্রমাণিত হয়েছেন । এরা আপনার এবং আমার মতো নিরপরাধ লোকেদের হাতে পেতে অপেক্ষা করছে! আপনি আপনার ফোন বা কম্পিউটারের ব্রাউসার এ কোন ওয়েবসাইটের কোন লিংক এ আছেন, এটি একটি ভ্যালিড বা যুক্তিসঙ্গত লিংক কিনা যাচাই করুন, পারলে লিংক টাতে ঢুকবার আগে যাচাই করুন। ব্রাউসার ও লিংক এর ব্যবহার ভালো জানা না থাকলে জেনে নিন।
আলাদা অ্যাকাউন্ট
সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধির সাথে সাথে, আপনাকে ইন্টারনেটে আপনার জীবনের সমস্ত ধরণের মানুষের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করতে হয়। এর মানে হল আপনার শিক্ষক এবং আপনার অফিসের বস থেকে শুরু করে আপনার বন্ধু এবং পরিবারের সবাই আপনার সাথে অনলাইনে দ্রুত যোগাযোগ করতে সক্ষম। অনেক সময়, কিছু নির্দিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে কিছু গোপনীয়তা সেটিংস, আপনি নির্দিষ্ট লোকেদের দেখাতে চান এমন পোস্ট এবং তথ্য বাছাই করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পৃথক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করুন যাতে আপনার অ্যাকাউন্ট এবং ডেটা পরিচালনা করা আপনার পক্ষে সহজ হয়। আপনি চান না যে আপনার অত্যধিক সুরক্ষাকারী বোনটি আপনার জীবনের প্রথম ডেটে আপনি কী করেছিলেন তা দেখুক, তাই না?
সীমিত প্রবেশাধিকার
বেশিরভাগ ওয়েবসাইট আপনাকে নির্দিষ্ট সামগ্রীতে অ্যাক্সেস বা প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ করার অপশন সরবরাহ করে। এর মানে হল যে, আপনি কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সাধারণভাবে সমগ্র জনসাধারণের কাছ থেকে আপনার ডিজিটাল পণ্য, পোস্ট ইত্যাদি আড়াল করতে পারেন এর মাধ্যমে ৷ আপনার গোপনীয়তা বাড়ানোর জন্য এবং নিরাপদ থাকার জন্য আপনাকে সেই অপশনগুলির সর্বোত্তম ব্যবহার করা উচিত। আপনার বা আপনার ভাই-বোনদের একজনের সহপাঠীদের মধ্যে একজন, যে কিনা আপনাকে বা তাকে অফলাইনে বা অনলাইনে বুলি করছে, যদি আপনার পোস্টকৃত একটি টুইট খুঁজে পায়, যা আপনি বা আপনারা চাননা সে জানুক, তবে এটি খুব ভাল হবে না। এ ক্ষেত্রে দায়ী কে? অথবা ধরে নেওয়া যাক আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় একটি কোর্সে ‘ডি’ গ্রেড পেয়েছেন, ধরা যাক, ম্যানুফ্যাকচারিং টেকনোলজিস -এ, এবং আপনি এটি সম্পর্কে গর্বিতভাবে ব্যঙ্গাত্মক, সামান্য পুরানো ইনস্টাগ্রাম পোস্ট করেছিলেন এবং আপনার গোপন প্রেমিকা সেখান থেকে এটি খুঁজে পেয়েছেন, এটিও নিশ্চই চমকপ্রদ কিছু হবেনা । সুতরাং, প্রিয় বন্ধু, সাইবার জগতে নিরাপদ থাকুন এবং নিজের প্রিয়জনদের নিরাপদ রাখুন।
বোনাস: নিরাপদ ব্রাউসার ও সার্চ ইঞ্জিন
এটা এখন অজানা নয় যে বেশিরভাগ সার্চ ইঞ্জিন বা ব্রাউসিং প্রোডাক্ট এমনকি গুগল এর প্রোডাক্ট গুলোও আপনাকে ট্র্যাক করে এবং আপনার তথ্য ব্যবহার করে । এমনকি এর অনুমতি আপনি নিজেই ওদেরকে দিয়ে থাকেন । কোনো কিছু জানতে হলে বা কোনো ওয়েবসাইট এ যেতে হলে ডিফল্ট ব্রাউসার হিসেবে একটি নিরাপদ ব্রাউসার এবং একটি নিরাপদ সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করুন । সরল-সহজগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘DuckDuckGo’। এরা আপনার তথ্য ব্যবহার বা বিক্রি করবেনা এবং আপনাকে ট্র্যাক করবেনা। আপনি যদি এন্ড্রোইড ব্যবহারকারী হন, এবং গুগল এর পণ্য বা সেবা গুলো আপনার ডিফল্ট হয়ে থাকে, তার মানে গুগল আপনার সম্পর্কে এতটা জানে যা আপনি নিজেই জানেন না!
পরিচয়: মুত্তাকীন রশিদ আলভী আলাদিন তুরস্কের METU বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। এখন একজন সাইবার সিকিউরিটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি লিখালিখি করতে ও ফুটবল খেলতে ভালোবাসেন।